নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণের চাল চোর নিয়ে দেশ জুড়েই সমালচনার ঝড় বইছে। এরই মধ্যে চাল চুরির অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হওয়ায় বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। যাদের মধ্যে একজন বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের আলোচিত ও বিতর্কিত চেয়ারম্যান নূরে আলম বেপারী। যার বাড়ি থেকে জেলেদের জন্য বিশেষ বরাদ্দের ১৮৪ বস্তা ত্রাণের চাল উদ্ধার করে র্যাব। এই ঘটনায় র্যাব বাদী হয়ে চেয়ারম্যান ও তার চাল চোর সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এমনকি চেয়ারম্যানের পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয় তাকে। তবে মামলার এরপর থেকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে আত্মগোপনে চলে যান বহিস্কৃত চেয়ারম্যান নূরে আলম। টানা দুই মাস পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হলেও অনেকটা জামাই আদরেই জেলে পাঠানো হয়েছে চাল চোর চেয়ারম্যান নূরে আলম বেপারীকে। আর আইন ভেঙে জামাই আদরের এই ব্যবস্থা করেছেন বাবুগঞ্জ থানা এবং কোর্ট পুলিশ। জানাগেছে, ‘মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বাবুগঞ্জ উপজেলার স্টিমারঘাট এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় ত্রাণের চাল আত্মসাতের মামলার প্রধান আসামি নূরে আলম বেপারীকে। কিন্তু বিষয়টি সাংবাদিকদের টের পাওয়ার আগেই তাকে কোর্টে চালান করা হয়। বাবুগঞ্জ থানা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘রাজনৈতিক চাপে চাল চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত নূরে আলম বেপারীকে অনেকটা জামাই আদরেরই আদালতে প্রেরণ করা হয়। একজন পলাতক আসামি হিসেবে তাকে গ্রেফতার দেখানো হলেও কোর্টে নিয়ে যাবার সময় তাকে পড়ানো হয়নি হাতকড়া।
শুধু তাই নয়, হাত কড়া ছাড়া কোর্টে প্রেরনের চিত্র যাতে সাংবাদিকদের চোখে না পড়ে সে কারণেই তড়িঘরি করে আদালত কার্যক্রম শুরুর আগেই বাবুগঞ্জ থানা থেকে তাকে কোর্টে প্রেরণ করা হয়। এদিকে কোর্টে নেয়ার পরেও সেই একই আয়োজন। মামলার আসামিদের কোর্টে নেয়ার পরে তাদের রাখা হয় গারদখানায়। কিন্তু নূরে আলমের ক্ষেত্রে ঘটেছে ভিন্নটা। চাল চুরির মামলায় বহিস্কৃত এই চেয়ারম্যানকে গারদে না রেখে জামাই আদরে গারদখানার সামনে চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়েছে। এমনকি পড়ানো হয়নি হাতে হাতকড়াও। সকাল থেকে বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে গারদখানার বাইরে জামাই আদরে চাল চোর চেয়ারম্যানকে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করে জেল পুলিশ। তাছাড়া গারদখানা থেকে পুলিশের ভ্যানে তোলার সময়েও আলোচিত চেয়ারম্যান নূরে আলমের হাতে হাতকড়া দেখা যায়নি। যা গারদে থাকা অন্যান্য আসামিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। হাতকড়া না পরিয়ে পুলিশের ভ্যানে তোলা এবং গারদে না রেখে বাইরে চেয়ারে বসিয়ে আদর আপ্যায়নের বিষয়ে জানতে কোর্ট পুলিশকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘উনি ভিআইপি লোকতো তাই একটু সম্মান করা হয়েছে মাত্র।
এদিকে একজন চাল চোরকে নিয়ে পুলিশের এমন নাটকিয়তায় ক্ষুব্ধ হয়েছে সচেতন মহলও। তারা বলছেন অপরাধী না হয়েও একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে আদালত চত্ত্বর থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোন প্রকার অসুস্থ না হলেও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে একটু আরাম আয়েশের জন্য জেলখানার মেডিকেলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে নূরে আলমের। অথচ সেই আদালত চত্ত্বরেই একজন চাল চোর চেয়ারম্যানকে পুলিশের এমন জামাই আদর মোটেই কাম্যনয় বলে মন্তব্য করেছেন ঘটনার সময় আদালত চত্ত্বরে উপস্থিত বিভিন্ন বিচার প্রার্থী ও তাদের স্বজনরা। প্রসঙ্গত, ‘গত ১৫ এপ্রিল রাতে বাবুগঞ্জ উপজেলার স্টিমারঘাট এলাকায় চেয়ারম্যান নূরে আলম বেপারীর বাড়ি থেকে জেলেদের জন্য বিশেষ বরাদ্দের ভিজিডি’র প্রায় ৬ মেট্রিকটন সরকারি চাল জব্দ করে র্যাব-৮। তবে তাকে গ্রেফতার করতে না পারলেও ওই রাতেই র্যাব-৮ এর ডিএডি আবু হোসেন শাহরিয়ার বাদী হয়ে বাবুগঞ্জ থানায় চেয়ারম্যান নূরে আলম ও তার ভাইসহ চার জনকে আসামি করে বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে মামলা দায়ের করেন। সেই থেকেই আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। তাছাড়া চাল চুরির অভিযোগে গত ২৩ এপ্রিল নূরে আলম বেপারীকে বহিষ্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তবে দেশের চরম সংকটের মধ্যে চাল চুরি করে ধরা পড়ার পরেও দলীয় পদে বহাল রয়েছেন দুর্নীতিগ্রস্ত এই চেয়ারম্যান। ঘটনার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে তাকে বহিষ্কার করেনি উপজেলা আওয়ামী লীগ। এমনকি বহাল রয়েছে উপজেলা যুবলীগের পদও।
বাবুগঞ্জ থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা নূরে আলম বেপারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ অন্তহীন। র্যাব কর্তৃক তার গ্রামের বাসভবন থেকে বিপুল পরিমাণ সরকারি চাল উদ্ধারের খবর পেয়েই গা-ঢাকা দেন তিনি। অনেকদিন ধরেই তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছিল।
তবে সুচতুর নূরে আলম গ্রেফতার এড়াতে খুব দ্রুত নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতেন। গতকাল খুব ভোরে তিনি ইটভাটায় এসেছেন মর্মে নিশ্চিত হলেও তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি। পরে ইটভাটা থেকে বেরিয়ে যাবার পথে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি জানান, ‘র্যাবের দায়ের করা ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে নূরে আলম বেপারীকে গতকাল মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হয়। এসময় তার পক্ষে জামিন আবেদন করা হলেও বিচারক তা না মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ‘স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ছত্রছায়ায় থেকে দীর্ঘ দিন ধরেই একের পর এক অপকর্ম করে আসছিলেন নূরে আলম বেপারী। দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীর্ঘ দিন ধরে ত্রাণের ভিজিডি, ভিজিএফ এবং ১০ টাকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল আত্মসাত করে তা গোডাউনে বসেই বিক্রি করতেন। এছাড়াও সরকারি খাসজমি দখল করে বহুতল ভবন এবং অবৈধ ইটভাটা নির্মাণ, হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে বাবুগঞ্জের সুগন্ধা ও সন্ধ্যা নদীতে অসংখ্য ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাছাড়া ১৪ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েও ইট না দিয়ে প্রতারণা করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আদালতে চেক জালিয়াতির মামলা করেন নিপা খান নামে গড়িয়ার পাড় এলাকার এক নারী।
Leave a Reply